রবিবার, ১ মে, ২০২২

 

পঞ্জিকা


পঞ্জিকা বছরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পর্বদিন ইত্যাদি সংবলিত গ্রন্থ। একে পঞ্জী বা পাঁজিও বলা হয়। প্রাচী সংস্কৃত সাহিত্যে একে বলা হয়েছে ‘পঞ্চাঙ্গ’। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও এটি এই নামে পরিচিত। এর কারণ এতে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ প্রধানত এই পাঁচটি অঙ্গ থাকে। বাংলায় অবশ্য এটি পঞ্জিকা নামেই সুপরিচিত।


বাংলাদেশের পঞ্জিকায় সংস্কারের ফলে নাক্ষত্রিক পঞ্জিকা বাংলা সন এখন থেকে সৌর পঞ্জিকা হয়ে গেছে। কারণ আগে এর বর্ষশুরু নক্ষত্রের অবস্থানের ওপর নির্ভর ছিলএখন তা সৌর পঞ্জিকা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিন তথা ১৪ এপ্রিল শুরু হবে। বৈশাখজ্যৈষ্ঠআষাঢ়শ্রাবণভাদ্রআশ্বিন ৩১ দিনের হবে। কার্তিকঅগ্রহায়ণপৌষমাঘ ও চৈত্র ৩০ দিনের হবে। ফাল্গুন হবে ২৯ দিনের। আগে আশ্বিন ও ফাল্গুন ছিল ৩০ দিনের। দুই ভাবেই মোট ৩৬৫ দিন। এখনো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যে বছর অধিবর্ষ হবে অর্থা ৩৬৬ দিনে বছর হবেসে বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হয়ে বাংলা বছরও ৩৬৬ দিনের হবে। এর ফল আমরা পাব ফাল্গুন মাসে। এখন আর ২১ ফেব্রুয়ারি ৯ ফাল্গুন হবে না৮ ফাল্গুনই হবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১ ফাল্গুনেই ‘ভালোবাসা দিবস হবে। সারা বাংলায় নববর্ষও একই দিন ১৪ এপ্রিল হবে।

ব্রিটিশ রাজত্ব অবসানের পর সারা দেশের জন্য একটি একই রকম পঞ্জিকা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ভারত সরকার ১৯৫২ সালের নভেম্বরে ডমেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। মেঘনাদ সাহা কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করে যে, (১) প্রচলিত নাক্ষত্রিক পঞ্জিকার (sidereal calendar) পরিবর্তে ক্রান্তীয় পঞ্জিকা (tropical calendar) চালু করা২) বছরের শুরু বৈশাখের পরিবর্তে চৈত্র থেকে শুরু করা৩) চৈত্র মাস ছয়-সাতদিন দেরিতে শুরু করা এবং ৪) শকাব্দকে জাতীয় পঞ্জিকা ঘোষণা করা হোক।


বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা দক্ষিণ এশিয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা একটি ফসলি পঞ্জিকা ও নাক্ষত্রিক পঞ্জিকা। এর প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সময়ে রয়েছে বাংলার তিনটি ফসল মৌসুমযথা আউশআমন ও রবি। বাংলা পঞ্জিকার বছরকে চার মাস ধরে ভাগ করে সহজেই এ ফসল মৌসুমগুলো চিহ্নিত করা যায়। ব্যবসায়ীরা এ পঞ্জিকার প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে হালখাতা করে নববর্ষ হিসেবে এবং শেষ দিন ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসাব বন্ধ করে ও চৈত্রসংক্রান্তি হিসেবে সারা বাংলায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পালিত হওয়ায় এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। লক্ষণীয়ফসলি পঞ্জিকার প্রথম দিনে নববর্ষ পালনের ঐতিহ্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কম্বোডিয়ালাওসথাইল্যান্ডইউনানমিয়ানমারমালয়সুমাত্রাশ্রীলংকাতামিলনাড়ুঅন্ধ্রকেরালাওড়িশাবিহারআসামসহ সমগ্র উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতনেপালপাঞ্জাব ও কাশ্মীর প্রভৃতি দেশেও পালিত হয়। এ বিশাল অঞ্চলটি মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত বিধায় ধারণা করা যায়সুদূর অতীত থেকেই এ অঞ্চলে ফসলি পঞ্জিকা বিরাজ করছে।


প্রকৃতপক্ষে বাংলার সৌর পঞ্জিকাটি একটি অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য। বাংলার বর্তমান সাল গণনার গোড়ায় আজ থেকে ১৪২৫ বছর পূর্বে পৌঁছালে আমরা যে রাজার অভিষেকের বছর পাইতাঁর নাম শশাঙ্ক।   এ পঞ্জিকা সম্পর্কে অনেক ঐতিহাসিক বলেনইংরেজি ১৫৮৪ সালে আকবরের সভাসদ আমির ফতেউল্ল­া সিরাজী এর উদ্ভাবন করেন। তাঁরা বলেনহিজরি সাল অনুযায়ী খাজনা আদায়ের অসুবিধা দূর করতে চান্দ্র হিজরি পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করে তিনি বাংলা পঞ্জিকার জন্ম দেন। কথাটি অসত্যকারণ এর সপক্ষে প্রকৃতই কোনো ইতিহাস নেই। আইন--আকবরি থেকে যে ইতিহাস উল্লে­খ করা হয়তা মোটেই বাংলা পঞ্জিকার জন্ম নিয়ে নয়তা হলো আকবর কর্তৃক ‘ইলাহি সন’-এর জন্ম নিয়ে। প্রকৃত সত্য হলোবাংলা পঞ্জিকা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত সৌর পঞ্জিকাগুলোরই একটি। ফতেউল্ল­া সিরাজী বাংলা পঞ্জিকা উদ্ভাবন করেননিবরং তিনি বাংলার সমতলে প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকাকে খাজনা আদায়ের বছর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

আকবরনামা পড়ে জানা যায় সেই সময় বাংলার মানুষের নিজস্ব পঞ্জিকা ছিল। ওই সময় জনগণের মধ্যে ফসলি সাল গণনারও প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। তবে ওই পঞ্জিকায় বছর কবে শুরু হতোতা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কারণ ‘আইন-ই আকবরি গ্রন্থে শকাব্দের বছর চৈত্র মাস থেকে শুরু দেখা যায়। চৈত্র মাস থেকে শুরু হিন্দু মাসগুলো ৩০ দিন করে। সৌর বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার জন্য যে মাসকে দুবার গণনা করা হয়তার নাম অধিমাস বাংলা পঞ্জিকার শুরুর দিন হচ্ছেসূর্য তার যাত্রাপথে যেদিন নাক্ষত্রিক মেষরাশিতে (Sidereal Aries) প্রবেশ করেসেদিন থেকে। এটি সাধারণত ১৪ বা ১৫ এপ্রিল নাগাদ ঘটে। বাংলা চলতি পঞ্জিকা তাই একটি নাক্ষত্রিক পঞ্জিকা (Sidereal calendar) নাক্ষত্রিক পঞ্জিকার বছর সৌর পঞ্জিকা বছরের চেয়ে সামান্য দীর্ঘতর। বাংলা পঞ্জিকায় ১৫৮৪ সালে পহেলা বৈশাখ ছিল ১১ এপ্রিল। গত ৫০০ বছরে গ্রেগরিয়ান সৌর পঞ্জিকার (Solar calendar) তুলনায় নাক্ষত্রিক বাংলা পঞ্জিকার বর্ষশুরু তিনদিন পিছিয়েছে। কিন্তু এখন থেকে বাংলা পঞ্জিকা সৌর পঞ্জিকা হওয়ায় সূর্যের অবস্থান ধরে আর পেছাবে না।

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ


শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ   


    

বাংলা ক্যালেন্ডারে একটি মাসকে সাধারণত ৩০ দিনে ভাগ করা হয় এবং এই মাসগুলি সূর্য 🌞ও চন্দ্রের 🌙 গতিবিধি অনুসারে গণনা করা হয়চাঁদের কম-বেশি পর্যায় অনুসারে মাসকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়যার মধ্যে ১৫ দিনের এক দিককে শুক্লপক্ষ এবং বাকি ১৫ দিনকে কৃষ্ণপক্ষ বলা হয়। শুক্লপক্ষের শেষ তিথিকে বলা হয় পূর্ণিমা 🌕 এবং কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথিকে বলা হয় অমাবস্যা 🌑আসুন জেনে নেই বৈদিক শাস্ত্রে এই দুটি দিক সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনাঃ 👇 


পক্ষ অর্থ কি? 


জ্যোতিষশাস্ত্রীয় ক্যালেন্ডার অনুসারে, প্রতিটি চান্দ্র মাস দুটি দিকে বিভক্তপক্ষ একটি চান্দ্র পাক্ষিকএটি প্রায় ১৪ দিনের সময়কাল। 'পক্ষ' শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল দিক বা দিকএছাড়াও, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, পক্ষ মানে এক মাসের একটি পক্ষএটি শুক্লপক্ষ বা কৃষ্ণপক্ষএটি চাঁদের পর্যায়প্রতিটি চাঁদ পর্ব ১৫ দিন স্থায়ী হয়তাই সাধারণত প্রতি মাসে দুটি চাঁদের দশা থাকে! গণনা অনুসারে, চাঁদ একদিনে ১২-ডিগ্রি কক্ষপথ সম্পূর্ণ করে। ৩০ দিনে, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একটি প্রদক্ষিণ সম্পূর্ণ করেএই চাঁদ প্রতিসপ্তাহে একটি পর্যায় সম্পন্ন করে যা বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে অনেক সাহায্য করে 


এক মাসে কয়টি পক্ষ থাকে? 


হিন্দু ক্যালেন্ডার অর্থাপঞ্চাং অনুসারে প্রতি মাসে সাধারণত ৩০ দিন থাকে এবং এই মাসগুলি সূর্যচন্দ্রের গতিবিধি অনুসারে গণনা করা হয়চন্দ্রের পর্যায় কম বা বেশি সে অনুযায়ী মাসটিকে দুটি পক্ষে বিভক্ত করা হয়, যেগুলোকে কৃষ্ণপক্ষ বা শুক্লপক্ষ বলা হয়। সুতরাংচান্দ্রমাসে দুটি পক্ষ থাকেসাধারণত পূর্ণিমার পরের দিন থেকে শুরু করে অমাবস্যা পর্যন্ত একটি পক্ষ ধরা হয় এবং অন্যদিকে অমাবস্যার পরের দিন থেকে শুরু করে পুনরায় পূর্ণিমা পর্যন্ত আরেকটি পক্ষ ধরা হয়তাহলে প্রতি মাসে দুটি পক্ষ পড়লেও পূর্ণিমাঅমাবস্যা সংঘটিত হয় মাত্র একবার করেই 




তিথি:

জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রতিটি চান্দ্রমাসকে ত্রিশটি দিনে বিভক্ত করা হয়প্রতিটি চান্দ্রমাসের এই এক একটি দিনকে 'তিথি' বলা হয়অর্থাৎ, ত্রিশ তিথিতে এক চান্দ্রমাসএই ত্রিশ তিথিকে আবার দুই পক্ষে বিভক্ত করা হয়পনেরো চান্দ্রদিবস নিয়ে এক একটি পক্ষ। চান্দ্রমাসের প্রথম তিথি থেকে পঞ্চদশ তিথি পর্যন্ত হচ্ছেশুক্লপক্ষ এবংষোড়শ' তিথি থেকেত্রিংশ' তিথি পর্যন্ত হচ্ছেকৃষ্ণপক্ষ'।চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রতিটি দিনের বিশেষ নাম আছে 

see more



 
শুক্লপক্ষকৃষ্ণপক্ষের দিন সমূহঃ 


শুক্ল পক্ষ 

কৃষ্ণ পক্ষ 

১. প্রতিপদ 

১. প্রতিপদ 

২. দ্বিতীয়া 

২. দ্বিতীয়া 

৩. তৃতীয়া 

৩. তৃতীয়া 

৪. চতুর্থী 

৪. চতুর্থী 

৫. পঞ্চমী 

৫. পঞ্চমী 

৬. ষষ্ঠী 

৬. ষষ্ঠী 

৭. সপ্তমী 

৭. সপ্তমী 

৮. অষ্টমী 

৮. অষ্টমী 

৯. নবমী 

৯. নবমী 

১০. দশমী 

১০. দশমী 

১১. একাদশী 

১১. একাদশী 

১২. দ্বাদশী 

১২. দ্বাদশী 

১৩. ত্রয়োদশী 

১৩. ত্রয়োদশী 

১৪. চতুর্দশী 

১৪. চতুর্দশী 

১৫.পূর্ণিমা 

১৫. অমাবস্যা 

 

শুক্লপক্ষ কি? 


অমাবস্যাপূর্ণিমার মধ্যবর্তী অংশকে শুক্লপক্ষ বলা হয়। অমাবস্যার পরের ১৫ দিনকে শুক্লপক্ষ বলা হয়। শুক্লপক্ষ ১৫ দিনের একটি সময়কাল যা শুরু হয় শুক্ল আমাবস্যার (নতুন চাঁদ) দিন এবং সমাপ্তি পূর্ণিমার (পূর্ণিমা) দিন। অমাবস্যার পরের দিন থেকেই চাঁদ উঠতে শুরু করে বা বলা হয় চাঁদের পর্যায়ও বাড়ে যার কারণে চাঁদ বড় হয় এবং রাতগুলো অন্ধকার থাকে না, বরং চাঁদের আলোয় আলোকিত হয় উঠে যায়। এটি শুভ হিসাবে বিবেচিত হয় 


শুক্লপক্ষে শুভ কাজ করা হয়:


পূর্ণিমার দিনে চাঁদ অনেক বড় এবং আলোয় পরিপূর্ণ হয়এই সময়ে, চাঁদ শক্তিশালী থাকে এবং তার পূর্ণ আকারে থাকে, তাই এই দিকটি যে কোনও শুভ কাজের জন্য উপযুক্ত এবং সেরা হিসাবে বিবেচিত হয়। কারণ এর আগমন প্রতিটি জীবের মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক অবস্থার বৃদ্ধি বা সম্প্রসারণের পক্ষে অনুকূল। শুক্লপক্ষে যে কোনো নতুন কাজও শুরু হয় 

 

শুক্লপক্ষের তারিখ:


১৫ দিন (অমাবস্যা, প্রতিপদ, প্রতিপদ, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী)। এই সময়কালে অসংখ্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয় নবরাত্রি উৎসব, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চৈত্র নবরাত্রি এবং আশ্বিন নবরাত্রি।  


দিন 

তিথি 

উৎসব 

মাস 

১ম দিন 

প্রতিপদ 

বালি প্রতিপদ, গোবর্ধন পূজা 

কার্তিক 

২য় দিন 

দ্বিতীয়া 

ভাইফোঁটা 

কার্তিক 

৩য় দিন 

তৃতীয়া 

তিজ 

ভাদ্রপদ 

৩য় দিন 

তৃতীয়া 

অক্ষয়া তৃতীয়া 

বৈশাখ 

৪র্থ দিন 

চতুর্থী 

গণেশ চতুর্থী 

ভাদ্রপদ 

৪র্থ দিন 

চতুর্থী 

গণেশ জয়ন্তী 

মাঘ 

৫ম দিন 

পঞ্চমী 

নুয়াখাই 

ভাদ্রপদ 

৫ম দিন 

পঞ্চমী 

বিবাহ পঞ্চমী 

মার্গশীর্ষ 

৬ষ্ঠ দিন 

ষষ্ঠী 

শীতলষষ্ঠী 

জ্যৈষ্ঠা 

৯ম দিন 

নবমী 

রাম নবমী 

চৈত্র 

১০ম দিন 

দশমী 

বিজয়া দশমী 

আশ্বিন 

১১তম দিন 

একাদশী 

সায়নী একাদশী 

আষাঢ় 

১১তম দিন 

একাদশী 

বৈকুণ্ঠ একাদশী 

মার্গশীর্ষ 

১৪তম দিন 

চতুর্দশী 

সংবৎসরী 

ভাদ্রপদ 

১৫তম দিন 

পূর্ণিমা 

গুরু পূর্ণিমা 

আষাঢ় 


কৃষ্ণপক্ষ কি? 


পূর্ণিমাঅমাবস্যার মধ্যবর্তী অংশকে কৃষ্ণপক্ষ বলে। কৃষ্ণপক্ষ অন্ধকার বোঝায় চন্দ্র পাক্ষিক বা ক্ষীয়মাণ চাঁদ। এটা বিশ্বাস করা হয় যে পূর্ণিমার পরের দিন থেকে কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়, যা অমাবস্যা তিথির আগমন পর্যন্ত ১৫ দিন স্থায়ী হয়। কৃষ্ণপক্ষ ১৫ দিনের সময়কাল যা শুরু হয় পূর্ণিমার দিন, সমাপ্তি  অমাবস্যার দিনকৃষ্ণপক্ষের সময়কালে চাঁদ আলোক হারায়, এই কারণে এটি অশুভ বিবেচিত হয় 


কৃষ্ণপক্ষে শুভ কাজ করা হয় না:


কৃষ্ণপক্ষ কোনো শুভ কাজের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না এবং বলা হয় যে এই পক্ষ বা এই সময়ে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা বিবাহ, শেভিং বা গৃহের মতো শুভউপলক্ষ এটি বিশ্বাস করা হয় যে যখনই কৃষ্ণপক্ষ থাকে, সেই সময়ে কোনও শুভ কাজ করা উপযুক্ত নয়আসলে, এর পিছনে জ্যোতিষশাস্ত্রে চাঁদের ক্রমহ্রাসমান পর্ব রয়েছেপূর্ণিমার পর দিন যত বাড়ে, চাঁদ তত কমতে থাকেঅর্থাচাঁদের আলো ক্ষীণ হতে থাকেচাঁদের আকারআলো কমে যাওয়ায় রাতগুলো অন্ধকার হতে থাকেএই কারণেও কৃষ্ণপক্ষকে শুভ বলে মনে করা হয় না, শুক্লপক্ষকে যতটা ধরা হয়আপনিও যদি পঞ্চাঙ্গে বিশ্বাস করেন, তাহলে কৃষ্ণপক্ষে কোনো বিশেষ কাজ করা থেকে বিরত থাকুন 


কৃষ্ণপক্ষের তারিখ:


১৫ দিন (পূর্ণিমা, প্রতিপদ, প্রতিপদ, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী) 

 

কৃষ্ণপক্ষের সময় উৎসব হলঃ 


দিন 

তিথি 

উৎসব 

মাস 

৪র্থ দিন 

চতুর্থী 

করভা চৌথ 

কার্তিক 

৮ম দিন 

অষ্টমী 

কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী 

শ্রাবণ 

১১তম দিন 

একাদশী 

বৈকুণ্ঠ একাদশী 

মার্গশির্ষ 

১৩ম দিন 

ত্রয়োদশী 

ধনতেরেস  

কার্তিক 

১৩ম দিন 

ত্রয়োদশী 

প্রদোশা 

মাঘা 

১৪তম দিন 

চতুর্দশী 

মহা শিবরাত্রি 

মাঘা 

১৪তম দিন 

চতুর্দশী 

নরক চতুর্দশী (দিওয়ালি) 

কার্তিক 

 

কোন পক্ষ শুভ? 


ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে মানুষ শুক্লপক্ষকে শুভ বলে মনে করে এবং কৃষ্ণপক্ষ এর বিপরীতেএই ধারণাটি চাঁদের জীবনী শক্তি এবং আলোকসজ্জার সাথে সম্পর্কিতজ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, শুক্লপক্ষের দশমী থেকে কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চম দিন পর্যন্ত সময়টিকে জ্যোতিষশাস্ত্রে শুভ বলে মনে করা হয়এই সময়ে, চাঁদের শক্তি বেশি বা প্রায় সর্বাধিক - যা শুভঅশুভ সময় নির্ধারণের জন্য জ্যোতিষশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় 


প্রাচীন ইতিহাস:


পুরাণের মতে কৃষ্ণপক্ষশুক্লপক্ষ কিভাবে শুরু হয়েছিল তা বুঝতে পারবেনতাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক শুক্লকৃষ্ণপক্ষ সম্পর্কিত ইতিহাসঃ 


কৃষ্ণপক্ষ কিভাবে শুরু হয়েছিল? 


শাস্ত্রে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে, দক্ষিণ প্রজাপতির ২৭টি কন্যা ছিল 👸তাদের সকলেরই চাঁদের সাথে দক্ষিণ প্রজাপতির বিয়ে হয়েছিলদক্ষিণ প্রজাপতির এই ২৭ কন্যা আসলে ২৭টি নক্ষত্রমণ্ডলী ছিলচাঁদ রোহিণীকে সব থেকে বেশি ভালবাসতচাঁদ সবসময় সবার সাথে অভদ্র ব্যবহার করতোএমতাবস্থায় অন্য সব নারীরা চাঁদের বিষয়ে পিতা মহাশয় দক্ষিণ প্রজাপতির কাছে অভিযোগ করেনএর পর রাজা দক্ষিণ প্রজাপতি চাঁদকে বকাঝকা করেন এবং সকল কন্যার সাথে সমান আচরণ করতে বলেনএরপরেও রোহিণীর প্রতি চাঁদের ভালোবাসা কমেনি এবং বাকি স্ত্রীদের উপেক্ষা করতে থাকেএতে রাজা দক্ষিণ প্রজাপতি ক্রুদ্ধ হয়ে চন্দ্রকে যক্ষ্মার অভিশাপ দেনএই অভিশাপের কারণে ধীরে ধীরে চাঁদের তেজ মাঝারি হয়ে যায়তখন থেকেই কৃষ্ণপক্ষের সূচনা ধরা হয় 


শুক্লপক্ষ কিভাবে শুরু হয়েছিল? 


দক্ষিণ প্রজাপতির অভিশাপের কারণে যক্ষ্মা রোগে চাঁদের তেজ কমে যায় এবং তার শেষ ঘনিয়ে আসতে থাকেতখন চন্দ্র ভগবান শিবের আরাধনা করেন এবং ভগবান শিব চন্দ্রের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে চন্দ্রকে নিজের চুলে আলিঙ্গন করেন। ভগবান শিবের কৃপায় চাঁদ আবার ফিরে আসতে শুরু করে এবং তিনি নতুন জীবন উপহার পানরাজা দক্ষের অভিশাপ ঠেকানো যায়নি, এমন অবস্থায় আভিশাপ বদলাতে গিয়ে ১৫ দিন অন্তর-অন্তর কৃষ্ণপক্ষেশুক্লপক্ষে যেতে হয় চাঁদকেএভাবে শুক্লপক্ষ শুরু হয় 

 

শুক্লকৃষ্ণ অর্থ? 


শুক্ল এবং কৃষ্ণের অর্থ বুঝতে পারলে, আমরা দুটি পক্ষের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য করতে পারিশুক্লা হল উজ্জ্বল, আর কৃষ্ণ মানে অন্ধকারআমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, শুক্লপক্ষ অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত শুরু হয় এবং শুক্লপক্ষের বিপরীতে কৃষ্ণপক্ষ পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত শুরু হয়প্রতি চন্দ্রমাসের পনেরো দিন আসে কৃষ্ণপক্ষে এবং বাকি পনেরো দিন শুক্লপক্ষেউভয় পক্ষেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তবে শুক্লপক্ষ যে কৃষ্ণপক্ষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত তাতে কোনো সন্দেহ নেইযদি আপনারও পঞ্চাঙ্গে বিশ্বাস থাকে তবে শুধুমাত্র শুক্লপক্ষে আপনার বিশেষ কাজ করুন 

 
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:

 
চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরার সময় প্রতিদিন ১২ ডিগ্রি কোণে আবর্তিত হয়এভাবে প্রতি মাসের শেষে ৩৬০ ডিগ্রি কোণ ঘোরে অর্থাপৃথিবীকে সম্পূর্ণ এক পাক দেয়ঠিক এভাবেই চান্দ্র বর্ষপঞ্জিতে এই পক্ষের ধারণা দেওয়া হয়েছেচাঁদের এই ১২ ডিগ্রি কোণে আবর্তনের ঘটনাকে একেকটিচন্দ্রকলাবলা হয়এই চন্দ্রকলার মধ্যে ষোলোটি কলা আছেচান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চাঁদের ষোলো কলা পূর্ণ হলে তবেই পূর্ণিমা হয়প্রত্যেক পক্ষেই এই কলা পূর্ণ হয় বা অবলুপ্ত হয় এবং তার ফলে পক্ষের শেষে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা দেখা যায়শুরুতে গাণিতিক হিসেবে যে তিরিশ দিনে এক মাসের কথা বলা হল, তা কিন্তু এই ক্ষেত্রে সেভাবে খাটে নাকারণ সাধারণত এক মাসে ৩০টি সৌরদিন থাকে, কিন্তু চান্দ্রমাস গড়ে ওঠে ২৯.৫ টি সৌরদিন নিয়েফলে চান্দ্র বর্ষপঞ্জিতে মোট দিনসংখ্যা হয় ৩৫৪। এদিকে আমরা সাধারণভাবে জেনেছি এক বছরে মোট ৩৬৫ দিন থাকেএখানেই স্পষ্ট করে মনে রাখা দরকার, আমাদের দিনক্ষণ হিসেব বা গণনার দুটি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়ইংরেজি ক্যালেণ্ডার অনুসরণ করে সৌর বর্ষপঞ্জি আর বাংলা পঞ্জিকায় অনুসৃত হয় চান্দ্র বর্ষপঞ্জিপ্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় খুব সহজে এই বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছেজ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী চাঁদের একটি পূর্ণিমা থেকে অপর পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কাল হল ১টি চান্দ্রমাস যাকে ৩০টি দিনে ভাগ করা হলে প্রত্যেক দিন তিথি হিসেবে ধার্য হয়সৌর বর্ষপঞ্জির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে এই তিথিগুলি সৌরদিনের চেয়ে খানিকটা বিস্তারে কমঠিক এই রকম ১৫টি করে তিথি নিয়েই গড়ে ওঠে চান্দ্রমাসের দুটি পক্ষপ্রতিটি তিথির সময় এক রকম হয় নামোটামুটিভাবে তিথিগুলি ২১.৫ ঘন্টা থেকে ২৬ ঘন্টা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকেঅন্যদিকে প্রতিটি সৌরদিনই ২৪ ঘন্টার হয়এখানেই সৌরদিনের সঙ্গে তিথির পার্থক্যসংস্কৃতশুক্লকথার অর্থ হল গৌর বা ফর্সা বা সাদাহিন্দু চান্দ্র বর্ষপঞ্জিতে অমাবস্যা থেকে শুরু করে পরবর্তী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫টি তিথির সময়কালকে বলা হয় শুক্লপক্ষএই সময় সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ থেকে ধীরে ধীরে চাঁদ ষোলোটি কলায় বাড়তে থাকে এবং পক্ষের শেষ দিন অর্থাপূর্ণিমায় একেবারে গোল থালার মতো উজ্জ্বল ছটাবিশিষ্ট চাঁদের দেখা মেলে আকাশেশুক্লপক্ষের সূচনা লগ্নের অমাবস্যাকে বলা হয় শুক্লা অমাবস্যা এবং এর পরের দিন থেকে তিথিগুলি নামাঙ্কিত হয় এভাবেপ্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী এবং শেষ দিনে পূর্ণিমা তিথি 

 

 

 

ধর্ম-জাত নির্বিশেষে চান্দ্রমাসচান্দ্রদিবসের এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছেবাঙালিদের মধ্যে এর গুরুত্ব আরো বেশিবাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজাপার্বণ, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ইদ-রোজা, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পূর্ণিমার উৎসব, উপজাতিদের নানান উৎসব - প্রায় সবকটির সঙ্গেই চান্দ্রমাস এবং নির্দিষ্ট চান্দ্রদিবস জুড়ে রয়েছে 


👉[জ্ঞাতব্য: চাঁদের আরবি মাসের তারিখ এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের চান্দ্রদিবসের মধ্যে এক দিনের পার্থক্য রয়েছেজ্যোতিষশাস্ত্রের দ্বিতীয় তিথি থেকে আরবি মাসের প্রথম তারিখ (দিন) শুরু হয়। ] 👈

 

আলোচিত প্রশ্ন সমুহঃ👇 

-পক্ষ মানে কিএক মাসে কয়টি পক্ষ থাকে? 
-শুক্লপক্ষের ও কৃষ্ণপক্ষের অর্থ? 
-কোন পক্ষ শুভঅশুভ? 
-কৃষ্ণপক্ষের শুরুশেষ? 
-কিভাবে শুরু কৃষ্ণপক্ষ এবং শুক্লপক্ষ? 
-কৃষ্ণপক্ষের কথাশুক্লপক্ষের কথা 
-শুক্লপক্ষের শুরুশেষ?
 

 







  পঞ্জিকা পঞ্জিকা বছরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পর্বদিন ইত্যাদি সংবলিত গ্রন্থ। একে পঞ্জী বা পাঁজিও ...