রবিবার, ১ মে, ২০২২

 

পঞ্জিকা


পঞ্জিকা বছরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পর্বদিন ইত্যাদি সংবলিত গ্রন্থ। একে পঞ্জী বা পাঁজিও বলা হয়। প্রাচী সংস্কৃত সাহিত্যে একে বলা হয়েছে ‘পঞ্চাঙ্গ’। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও এটি এই নামে পরিচিত। এর কারণ এতে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ প্রধানত এই পাঁচটি অঙ্গ থাকে। বাংলায় অবশ্য এটি পঞ্জিকা নামেই সুপরিচিত।


বাংলাদেশের পঞ্জিকায় সংস্কারের ফলে নাক্ষত্রিক পঞ্জিকা বাংলা সন এখন থেকে সৌর পঞ্জিকা হয়ে গেছে। কারণ আগে এর বর্ষশুরু নক্ষত্রের অবস্থানের ওপর নির্ভর ছিলএখন তা সৌর পঞ্জিকা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিন তথা ১৪ এপ্রিল শুরু হবে। বৈশাখজ্যৈষ্ঠআষাঢ়শ্রাবণভাদ্রআশ্বিন ৩১ দিনের হবে। কার্তিকঅগ্রহায়ণপৌষমাঘ ও চৈত্র ৩০ দিনের হবে। ফাল্গুন হবে ২৯ দিনের। আগে আশ্বিন ও ফাল্গুন ছিল ৩০ দিনের। দুই ভাবেই মোট ৩৬৫ দিন। এখনো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যে বছর অধিবর্ষ হবে অর্থা ৩৬৬ দিনে বছর হবেসে বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হয়ে বাংলা বছরও ৩৬৬ দিনের হবে। এর ফল আমরা পাব ফাল্গুন মাসে। এখন আর ২১ ফেব্রুয়ারি ৯ ফাল্গুন হবে না৮ ফাল্গুনই হবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১ ফাল্গুনেই ‘ভালোবাসা দিবস হবে। সারা বাংলায় নববর্ষও একই দিন ১৪ এপ্রিল হবে।

ব্রিটিশ রাজত্ব অবসানের পর সারা দেশের জন্য একটি একই রকম পঞ্জিকা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ভারত সরকার ১৯৫২ সালের নভেম্বরে ডমেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। মেঘনাদ সাহা কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করে যে, (১) প্রচলিত নাক্ষত্রিক পঞ্জিকার (sidereal calendar) পরিবর্তে ক্রান্তীয় পঞ্জিকা (tropical calendar) চালু করা২) বছরের শুরু বৈশাখের পরিবর্তে চৈত্র থেকে শুরু করা৩) চৈত্র মাস ছয়-সাতদিন দেরিতে শুরু করা এবং ৪) শকাব্দকে জাতীয় পঞ্জিকা ঘোষণা করা হোক।


বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা দক্ষিণ এশিয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা একটি ফসলি পঞ্জিকা ও নাক্ষত্রিক পঞ্জিকা। এর প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সময়ে রয়েছে বাংলার তিনটি ফসল মৌসুমযথা আউশআমন ও রবি। বাংলা পঞ্জিকার বছরকে চার মাস ধরে ভাগ করে সহজেই এ ফসল মৌসুমগুলো চিহ্নিত করা যায়। ব্যবসায়ীরা এ পঞ্জিকার প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে হালখাতা করে নববর্ষ হিসেবে এবং শেষ দিন ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসাব বন্ধ করে ও চৈত্রসংক্রান্তি হিসেবে সারা বাংলায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পালিত হওয়ায় এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। লক্ষণীয়ফসলি পঞ্জিকার প্রথম দিনে নববর্ষ পালনের ঐতিহ্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কম্বোডিয়ালাওসথাইল্যান্ডইউনানমিয়ানমারমালয়সুমাত্রাশ্রীলংকাতামিলনাড়ুঅন্ধ্রকেরালাওড়িশাবিহারআসামসহ সমগ্র উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতনেপালপাঞ্জাব ও কাশ্মীর প্রভৃতি দেশেও পালিত হয়। এ বিশাল অঞ্চলটি মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত বিধায় ধারণা করা যায়সুদূর অতীত থেকেই এ অঞ্চলে ফসলি পঞ্জিকা বিরাজ করছে।


প্রকৃতপক্ষে বাংলার সৌর পঞ্জিকাটি একটি অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য। বাংলার বর্তমান সাল গণনার গোড়ায় আজ থেকে ১৪২৫ বছর পূর্বে পৌঁছালে আমরা যে রাজার অভিষেকের বছর পাইতাঁর নাম শশাঙ্ক।   এ পঞ্জিকা সম্পর্কে অনেক ঐতিহাসিক বলেনইংরেজি ১৫৮৪ সালে আকবরের সভাসদ আমির ফতেউল্ল­া সিরাজী এর উদ্ভাবন করেন। তাঁরা বলেনহিজরি সাল অনুযায়ী খাজনা আদায়ের অসুবিধা দূর করতে চান্দ্র হিজরি পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করে তিনি বাংলা পঞ্জিকার জন্ম দেন। কথাটি অসত্যকারণ এর সপক্ষে প্রকৃতই কোনো ইতিহাস নেই। আইন--আকবরি থেকে যে ইতিহাস উল্লে­খ করা হয়তা মোটেই বাংলা পঞ্জিকার জন্ম নিয়ে নয়তা হলো আকবর কর্তৃক ‘ইলাহি সন’-এর জন্ম নিয়ে। প্রকৃত সত্য হলোবাংলা পঞ্জিকা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত সৌর পঞ্জিকাগুলোরই একটি। ফতেউল্ল­া সিরাজী বাংলা পঞ্জিকা উদ্ভাবন করেননিবরং তিনি বাংলার সমতলে প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকাকে খাজনা আদায়ের বছর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

আকবরনামা পড়ে জানা যায় সেই সময় বাংলার মানুষের নিজস্ব পঞ্জিকা ছিল। ওই সময় জনগণের মধ্যে ফসলি সাল গণনারও প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। তবে ওই পঞ্জিকায় বছর কবে শুরু হতোতা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কারণ ‘আইন-ই আকবরি গ্রন্থে শকাব্দের বছর চৈত্র মাস থেকে শুরু দেখা যায়। চৈত্র মাস থেকে শুরু হিন্দু মাসগুলো ৩০ দিন করে। সৌর বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার জন্য যে মাসকে দুবার গণনা করা হয়তার নাম অধিমাস বাংলা পঞ্জিকার শুরুর দিন হচ্ছেসূর্য তার যাত্রাপথে যেদিন নাক্ষত্রিক মেষরাশিতে (Sidereal Aries) প্রবেশ করেসেদিন থেকে। এটি সাধারণত ১৪ বা ১৫ এপ্রিল নাগাদ ঘটে। বাংলা চলতি পঞ্জিকা তাই একটি নাক্ষত্রিক পঞ্জিকা (Sidereal calendar) নাক্ষত্রিক পঞ্জিকার বছর সৌর পঞ্জিকা বছরের চেয়ে সামান্য দীর্ঘতর। বাংলা পঞ্জিকায় ১৫৮৪ সালে পহেলা বৈশাখ ছিল ১১ এপ্রিল। গত ৫০০ বছরে গ্রেগরিয়ান সৌর পঞ্জিকার (Solar calendar) তুলনায় নাক্ষত্রিক বাংলা পঞ্জিকার বর্ষশুরু তিনদিন পিছিয়েছে। কিন্তু এখন থেকে বাংলা পঞ্জিকা সৌর পঞ্জিকা হওয়ায় সূর্যের অবস্থান ধরে আর পেছাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

  পঞ্জিকা পঞ্জিকা বছরের প্রতিদিনের তারিখ, তিথি, শুভাশুভ ক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পর্বদিন ইত্যাদি সংবলিত গ্রন্থ। একে পঞ্জী বা পাঁজিও ...